মোমিন বান্দাদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস

পবিত্র মাহে রমযান মাস মোমিন বান্দাদের জন্য একটি প্রশিক্ষণের মাস। দীর্ঘ এক মাস নিয়মানুবর্তিতা সহকারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাকী ১১টি মাস আল্লাহর বিধি বিধান পালনের মাধ্যমে জীবন পরিচালনার জন্য পবিত্র রমযানের রোযা ফরজ করা হয়েছে। রোযা প্রতি বছর পূর্ণ একটি মাস ধরে দিন রাত প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানকে ইসলামী শরীয়ত পালনে অভ্যাস করায়। শেষ রাতে সেহরী খাওয়ার জন্য উঠতে হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বন্ধ রাখতে হয়। সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার করতে হয়।

আবার ইফতারের পর খানা পিনা করে একটু আরাম করার পরিবর্তে তারাবীহর নামায আদায় করতে হয়। আবার পরদিন রোযা পালনের জন্য সেহরী খেতে শেষ রাতে উঠতে হয়। এভাবে পূর্ণ একটি মাস সিপাহীর মতো কঠোর আইনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে হয়। জীবনের ত্রুটি বিচ্যুতি দূর করে পূণাঙ্গ মোমিন হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য রমযানের এই প্রশিক্ষণ। বাকী এগারটি মাস এ প্রশিক্ষনের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করলে পূণাঙ্গ মোমিন হিসেবে আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়া যাবে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। এ আয়াত প্রমাণ করে রোযা আমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরয ছিল। রমযান আরবী শব্দ। অর্থ দহন। ইসলামী বিশ্বকোষে রমযান অর্থ গ্রীষ্মের উত্তাপ উল্লেখ করা হয়েছে। রমযান মাসে মোমিন বান্দাদের গোণাহ ও অন্যায় রোযার মাধ্যমে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। একজন মুসলমানের জীবনের গোণাহ জ্বালিয়ে দিয়ে তাকে খাঁিট বান্দা হিসেবে গড়ে তুলতেই রমযানের এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে বান্দাহকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

পবিত্র রমযানের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যে ব্যক্তি জীবনের গোনাহ মাফ করাতে ব্যর্থ হয়েছে তার মতো র্দুভাগ্য ব্যক্তি আর কেউ নেই। এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। তিনি বলেছেন , ‘মাহে রমযানে সিয়াম সাধনার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে জাহান্নামের আগুন বিমুক্ত হতে সক্ষম হল না সে প্রকৃতপক্ষেই দুর্ভাগা।’

এ দুর্ভাগ্যের বোঝা মাথায় নিয়ে যারা নিজেদের জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিতে চায় তাদেরকে আজ এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে, সকলেরই মহান আল্লাহ পাকের নিকটে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ সীমাহীন যাত্রাপথের সম্বল সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জন করে নেয়াই শ্রেয়। জ্ঞান ও বিবেক সম্পন্ন মানুষ ন্যায় কল্যাণ এবং মঙ্গলময় জীবন যাপনেই আনন্দ পায়, শান্তি পায়। এ শান্তিই হোক সকলের কামনার ধন।

আল্লাহ তায়ালা তাকওয়া অর্জনের জন্য বহুবার মানুষকে তাগিদ প্রদান করেছেন পবিত্র আল কুরআনের মাধ্যমে। যেমন বলা হয়েছে- (হে ইমানাদারগণ তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃতুবরণ করো না) সুরা আল ইমরান-১০২) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- (নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানীত সে যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু)। অন্য আয়াতে রয়েছে- (হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ্য করে আগামী দিনের জন্য কি প্রস্তুত করেছে, আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত) সুরা হাশর-১৮। অন্য আয়াতে রয়েছে- (হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও) সুরা তওবা-১১৯। অন্য আয়াতে রয়েছে- (নিশ্চয়ই আল্লাহ যারা মুত্তাকী এবং যারা সৎকর্মপরায়নশীল তাদের সাথে রয়েছেন) সুরা নাহল-১২৮। অন্য আয়াতে রয়েছে- (তোমরা সৎ ও তাকওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা কর তোমরা পাপ ও সীমালংঘনের কর্মে সহযোগিতা করনা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন শাস্তি দাতা) সুরা মায়েদা-২। অন্য আয়াতে রয়েছে- (হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার। সুরা বাকারা-১৮৯।

অন্য আয়াতে রয়েছে- (হে নবী আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং আপনি কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ করবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। সুরা আহযাব-১। এছাড়া ও অসংখ্য আয়াত রয়েছে যা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মানব জাতি এমন কি নবীকেও তাকওয়া অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যা দ্বারা তাকওয়া অর্জনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বুঝা যায়। কেন না তাকওয়া অর্জন ছাড়া একজন মানুষ মুমিনই হতে পারে না। তাকওয়া দ্বারা মানুষের গোটাজীবন পরিচালিত হয়। তাই যার মাঝে তাকওয়া নেই সে তার গোটা জীবন কুফরী অবস্থায় অতিবাহিত করে। পক্ষান্তরে যার মাঝে তাকওয়া রয়েছে তার গোটাজীবন পরিচালিত হয় মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিধান ও রাসূল (সা:) প্রদর্শিত আদর্শ মোতাবেক। তাই মানুষকে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে হলে সর্ব প্রথম তাকওয়া অর্জন করতে হবে। কেননা তাকওয়া দ্বারাই প্রতিটি মানুষ স্ব-মহিমায় অবস্থান করতে পারে। তাকওয়া দ্বারা শুধু পরকালে লাভ রয়েছে এটাই শেষ কথা নয়।

পার্থিব সুখ-শান্তি বজায় রাখতে হলে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া অর্জন করার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটা ব্যাপক তা সূক্ষ্মভাবে আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন পূর্ববর্তী যত নবী ও রাসুল এ ধরায় আগমন করেছেন তাঁরা সকলেই তাঁর স্বীয় জাতিকে সর্বপ্রথম যে দাওয়াত পেশ করেছিলেন তার মধ্যে আল্লাহকে উপাস্যরূপে গ্রহণ এবং তাকওয়া অর্জনই ছিল মূল বিষয়। যথা হযরত হুদ (আ:) এর সম্পর্কে বলা হয়েছে- (স্মরণ করুন সে সময়ের কথা, যখন হুদ তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন তোমরা কি তাকওয়াশীল হবে না?) সুরা শুয়ারা-১২৪। অন্য আয়াতে হযরত সালেহ (আ:) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- (স্মরণ করুন সে সময়ের কথা যখন সালেহ (আ:) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর)। সুরা শুয়ারা-১৪২।

তেমনি অন্য আয়াতে হযরত লুৎ (আ:) এর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- (লুৎকে তার সম্প্রদায় মিথ্যা প্রতিপন্ন করে যে রাসূল হিসেবে এসেছিল। যখন সে তাঁর সম্প্রদায়কে তোমরা কি মুত্তাকী হবে না? আমি তোমাদের নিকট বিশ্বস্ত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর)। সুরা শুয়ারা-১৬১। অন্যত্র হযরত শোয়াইব (আ:) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- (স্মরণ করুন সে সময়ের কথা যখন শোয়াইব (আ:) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি মুত্তাকী হবে না? আমি তোমাদের নিকট বিশ্বস্ত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। সুরা শুয়ারা-১৭৭। পৃথিবীতে চুরি-ডাকাতি থেকে মুক্ত থাকতে পুলিশ চৌকিদার রাখা হয়। দোকান পাট সংরক্ষণ রাখতে সার্কিট ক্যামেরা, স্যাটেলাইট ও উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ সকল অন্যায়ের জন্য কোট-কাচারী, জেল, উকিল, জজ ইত্যাদি নিযুক্ত করা হয়। আর এ সকল তখন প্রয়োজন হবে না যখন প্রতিটি মানুষ একটি বিষয় বা একটি চরিত্র অর্জন করতে সক্ষম হবে তা হচ্ছে তাকওয়া। বর্তমান যুগে মারামারি, হানাহানি, চুরি-ডাকাতি, গুন্ডামী, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, সুদ-ঘুষ, কেলেঙ্কারী, করফাকি, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, কর্মেফাঁকি এ সকল বিষয় অহরহ চলছে।

আর যার প্রতিরোধ সরকার হরেকরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও এর কোন সমাধান করতে পারছে না, কিংবা পারবে বলে আশা করা যায় না। তবে আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত একটি পদক্ষেপই পৃথিবীর যাবতীয় দুর্নীতি ও কুকর্ম বিলুপ্ত করতে সক্ষম তা হচ্ছে- মানুষকে তাকওয়াবান হতে হবে। যদি কোন মানুষের মাঝে খোদাভীতি থাকে তাহলে সে কোন প্রকার অশ্লীল বা দুর্নীতি কাজে জড়িত হতে পারে না। মূলত এটাই তাকওয়া। আর যখনই কোন দুর্নীতিমূলক কর্ম সামনে আসবে তখন তার মন বাধা প্রদান করবে যে, আমাকে কাল কিয়মাতের দিন আল্লাহ এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে তখন আমি কি উত্তর দিব। এ ধরনের খোদাভীতি সকল মানুষের অর্জন করা একান্ত অপরিহার্য বিষয়। যে ব্যক্তি এ গুণ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সে মুত্তাকী।

তার ইহকালে যেমন মানুষের কাছে সম্মান রয়েছে, পরকালে রয়েছে অফুরন্ত নেয়ামত। যেমনি পবিত্র আল কুরআনের সুরা আ’রাফের ৯৬ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- (যদি গ্রামবাসিরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি আসমান এবং যমিনের সকল বরকতসমূহ তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতাম। তেমনি অন্য আয়াতে বর্ণিত আছে- (নিশ্চয়ই পরকাল যারা মুত্তাকী তাদের জন্য মঙ্গলময় হবে) সুরা আরাফ-১৬৯। এ গুণ লাভ করতে হলে সর্বোত্তম সময় হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। কারণ এ মাসে মানুষ রোজা রেখে সারাদিন কোন প্রকার গুনাহের কাজ তার দ্বারা সম্পাদন হয় না।

রাতের বেলা নফল নাজ পড়ে এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে। ফলে একজন মানুষ তাকওয়া অর্জনের মূলধারা বা পথ খুঁজে পায়। রমযানের মধ্যে মানুষ কোন প্রকার খারাপ বা অশ্লীল কাজ করতে সাহস করে না। রমযান মাসে মূল যে শিক্ষা তা মূলত এটাই যে তাকওয়া অর্জন। মানুষ রোযা রাখে সে সারাদিন উপবাস করে। তার সামনে অনেক খাবার ও পানীয় থাকে সে ইচ্ছে করলে তা খেতে পারে, কিন্তু সে তা স্পর্ষ ও করে না।

রমযান মাস মানুষকে তাকওয়ার শিক্ষাই দিয়ে থাকে। রমজান মাস আসলে স্বাভাবিকভাবে মানব সমাজে অনেক পরিবর্তন আসে। এসব পরিবর্তন মানব জাতিকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। পরবর্তী ১১টি মাস যাতে সে নিয়মমাফিক চলতে পারে তারই একটা ট্রেনিং হিসেব পবিত্র রমাজান মাস মানুষের দ্বারে দ্বারে প্রতি বছর একবার করে ঘুরে আসে। যে ব্যক্তি এ মাস কে গুরুত্ব সহকারে অতিবাহিত করবে সে পরবর্তী ১১টি মাস সকল কাজই মহান আল্লাহর রেজামন্দী মোতাবেক করতে সক্ষম হবে।

যে ব্যক্তি এ মাসকে অবহেলায় অতিবাহিত করল রোজা রাখলোনা, নামাজ পড়লো না, দান ছাদকা করলো না, পবিত্র রমজান মাস তার জন্য অভিসম্পাত করে। যেমনিভাবে রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন- (ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমজান মাস পেল অথচ এবাদত বন্দেগী করে সে আল্লাহ কাছে নিজের গুনাহকে ক্ষমা করিয়ে নিষ্পাপ হতে পারলো না)। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত পবিত্র মাহে রমজানকে যথাযথভাবে এবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা।

এসএইচ-০১/২০/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)