১০ টাকা কেজির চাল নিতে একজনেরই তিন কার্ড!

দরিদ্রদের জন্য সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি চাল বিতরণের কার্ড নিয়ে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার পাট্টা ইউনিয়নে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে জানেনই না তাদের নামে কার্ড হয়েছে। আবার একই ব্যক্তির নামে তিনটি কার্ড হয়েছে- এমন ঘটনাও আছে।

ইউনিয়নের তিনজন ডিলারের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার সুবিধা ভোগীকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া হয়। এরমধ্যে মো. জনাব আলী মন্ডল নামে এক ডিলার ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের ৪৯৬ জনের মাঝে চাল বিতরণের অনুমিত পান। তবে তার বরাদ্দ পাওয়া কার্ডের প্রায় ১০০ থেকে ১৩০টি কার্ডে অনিয়ম রয়েছে বলে জানা গেছে। একজনের নামে একাধিক কার্ড, নাম একজনের কিন্তু ছবি আরেকজনের, নাম মুসলমানের কিন্তু ছবি হিন্দু ব্যক্তির, কার্ডধারীর আঙ্গুলের ছাপ নাই কিন্তু চাল উত্তোলন হচ্ছে, যার নামে কার্ড হয়েছে তিনি জানেনই না- এমনভাবেই চলছে হতদরিদ্রদের চাল বিতরণের কার্যক্রম।

এ ঘটনায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মী, এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা কার্ডের সঠিক ব্যবহার ও অনিয়মকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, পাংশা উপজেলার পাট্টা ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড এলাকার হতদিরদ্রদের জন্য সরকারের দেয়া ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড হতদিরদ্ররা পাননি। পেয়েছেন স্বচ্ছল পরিবারের অনেকে। তবে এ কার্ডে ব্যাপক অনিয়ম

হামুয়াপাড়ার সুবিধাভোগী সোনা খাঁ বলেন, তার নামে ১০টাকা কেজি চালের ৩টি কার্ড হয়েছে। যার একটি কার্ডের চাল তিনি ৬ বার পেয়েছেন, এখন আর পান না। বাকি দুইটি কার্ড কে খায় তা তিনি জানেন না। তবে ৩টি কার্ড যে তার নামে, সেটা তিনি নিশ্চিত। কার্ডে তার নাম ও বাবার নামসহ সবই ঠিক আছে।

পুঁইজোরের মজিবর শেখ বলেন, চেয়ারম্যান-মেম্বর ১০ টাকা কেজি চালের ২টি কার্ড তার নামে করে দিয়েছেন। ফলে তিনি একাই ২টি কার্ডে ৬০ কেজি চাল উত্তোলন করেন।

মুচিদাহের রাশিদা ও ফুলমতি বলেন, কার্ডে তাদের নাম আছে, কিন্তু ছবির মিল নেই। এছাড়া তারা জানেনই না তাদের নামে কার্ড হয়েছে। এ কার্ডের চাল কে উত্তোলন করে, তাও জানেন না তারা। কিন্তু তারাই কার্ড পাবার যোগ্য।

ইউপি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর হুসাইন ও দফতর সম্পাদক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ডিলার জনাব আলী চাল বিতরণে চরম অনিয়ম করছেন। দরিদ্রদের নামে কার্ড হয়েছে, কিন্তু তারা চাল পায় না। তার দেয়া প্রায় ১৫০টি কার্ডে অনিয়ম রয়েছে। কার্ডে ছবি একজনের, নাম আরেকজনের। ফলে কার্ডে ছবি যার তিনিও চাল পান না, আবার নাম যার তিনিও পান না। এছাড়া একজনের নামে একাধিক কার্ডও আছে। হতদিরদ্রদের জন্য সরকারের দেয়া এ কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়নসহ দরিদ্ররা যেন এ সুবিধা পায় এবং কার্ড ও চাল বিতরণে অনিয়মকারীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তারা।

পাট্টার (৭, ৮ ও ৯) নং ওয়ার্ডের ডিলার জনাব আলী মন্ডল বলেন, চেয়ারম্যান ও মেম্বররা কার্ড তৈরি করে জনগণকে দিয়েছেন। তিনি সেই কার্ড অনুযায়ী চাল দেন। কিছুদিন আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে কার্ডগুলো চেয়ারম্যানের কাছে দিয়ে দেন। পরে চেয়ারম্যান নামে-বেনামে ছবি লাগিয়ে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। এ অনিয়ম চেয়ারম্যান-মেম্বররা করেছে, তিনি না।

পদাধিকার বলে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুর রব বিশ্বাস বলেন, তার ইউনিয়নের ৩ জন ডিলারের মধ্যে ইউপি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আলী মন্ডলের চাল বিতরণের কার্ডে অনিয়মের বিষয় জেনে সেগুলো জব্দ করেছেন। তার ৪৯৬টি কার্ডের মধ্যে জমা দিয়েছেন ৪৯১টি। বাকি ৫টি কার্ড হারিয়ে গেছে জানিয়েছেন ডিলার।

কার্ড তো ডিলার করেনি, করেছেন চেয়ারম্যান বা মেম্বর- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কার্ডে কোনো অনিয়ম নেই, অনিয়ম ডিলারের চাল বিতরণে। যখন কার্ড তৈরি হয় তখন তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু দ্বায়িত্ব বুঝে পাননি। তৎকালীন ইউপি সচিব ও ডিলার সমন্বয় করে কার্ড তৈরি করেন। কার্ডে সচিবের স্বাক্ষর আছে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের কোনো স্বাক্ষর নেই। কার্ডে যে অনিয়ম হয়েছে, সেটা তারাই করেছে। ওই কার্ডগুলোতে খাদ্য কর্মকর্তারও স্বাক্ষর আছে। তখন রমজান আলী ইউপি সচিব ছিলেন, বর্তমানে যিনি বাহাদুরপুর ইউনিয়নের সচিব। এপ্রিল মাসে নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু তিনি কার্ড পেয়েছেন ২৮ জুলাইয়ে । যার আগেই কার্ড সম্পন্ন হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, অনেকের নামে কার্ড আছে, কিন্তু চাল পাচ্ছে না। এ চাল ডিলার আত্মসাৎ করছেন। বিষয়টি নিয়ে গত মাসে আলোচনা হয়। পরবর্তীতে উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় এমপি সাহেব সব কার্ড জমা দিতে বলেন। তারই আলোকে ডিলার জনাব আলীর কাছ থেকে কার্ডগুলো বুঝে নেন এবং দেখেন সেগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। মেম্বর ও গ্রামপুলিশের মাধ্যম যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। নতুন করে সুবিধা ভোগীদের কার্ড দেবেন এবং তদন্তে যে দোষী প্রমাণিত হবে, তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এ জন্য তিনি মেম্বার শহিদুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করেছন।

পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড প্রধানমন্ত্রী গরিব, অসহায় ব্যাক্তিদের দিয়েছেন। তাই সে কার্ডে স্বচ্ছল ব্যাক্তির নাম থাকলে তা কেটে গরিবদের নামে বরাদ্ধ দেয়ার জন্য প্রত্যেক ইউপি চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো চেয়ারম্যান আপডেট দেননি। এছাড়া সুনির্দ্দিষ্ট করেও কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি । পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিএ-০৪/১৭-১০ (আঞ্চলিক ডেস্ক)