বারবার মিসক্যারেজ? গর্ভধারণের আগে মাথায় রাখুন এই পরামর্শগুলো

বারবার মিসক্যারেজ

প্রেগন্যান্সি মানে একটি স্বপ্ন। নানা জল্পনা-কল্পনা নিয়ে মা হওয়ার আশায় খুশিতে দিন কাটছিল বর্ণালীর। হঠাৎই স্বপ্নভঙ্গ! একবার নয়। এঘটনা তিনবার ঘটেছে। বারবার মিসক্যারেজের কারণ গর্ভাবস্থায় অফিস ছুটি না নেওয়া ও খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মকেই দায়ী করল পরিবার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাহ্যিক কোনও কারণ তাঁর এই সমস্যার জন্য দায়ী নয় তা সে জানতে পারেন চতুর্থবার গর্ভবতী হওয়ার আগে। জরায়ুর গঠনগত সমস্যাই বার বার তাঁর মা হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছিল। ডাক্তারের পরামর্শ মাফিক জরায়ুর নির্দিষ্ট অপারেশন করে অবশেষে মা হলেন আইটি সেক্টরে কর্মরতা বর্ণালী। এমন সমস্যা অনেকের জীবনেই ঘটে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তার সঠিক কারণ খুঁজে বের না করে হাল ছেড়ে দেন অধিকাংশই। মানসিক অবসাদে দিনযাপন করেন। তাই হতাশ না হলে পুনরায় গর্ভবতী হওয়ার কথা ভাবুন। আর অবশ্যই তার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে নিন নিজের শারীরিক সমস্যার ব্যাপারে।

গর্ভপাত বুঝতে

ডাক্তারি মতে, গর্ভবস্থায় একবার গর্ভপাত হওয়া অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। এমন হলে চিন্তার কারণ নেই। তবে তিনবারের বেশি কারও গর্ভপাত হলে তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় রেকারেন্ট মিসক্যারেজ বলে। যাদের এমন হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে গর্ভবস্থার প্রথম ১০ সপ্তাহের মধ্যে নাকি তারপরে গর্ভপাত হয়েছে তা দেখতে হবে। যদি আল্ট্রা সোনোগ্রাফিতে শিশুর ফিটাল হার্টবিট শোনা যায় তাহলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ কম থাকে। প্রেগন্যান্সির ৬ সপ্তাহ থেকেই আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে বাচ্চার স্পেশাল ট্র‌্যাক এবং ফিটাল হার্টবিট দেখা যায়। কিন্তু যদি গর্ভাবস্থায় ৬-৭ সপ্তাহতেও বাচ্চার স্যাক না আসে তাহলে গর্ভাবস্থায় গঠন ঠিকঠাক হয়নি বলে মনে করা হয়। আবার কারও ক্ষেত্রে স্যাক, ফেটাল পোল দেখা গেলেও ফিটাল হার্টবিট দেখা যায় না। তাদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত হয়েছে কিন্তু সেটি ডায়গনসিস হয়েনি। সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে আলট্রাসাউন্ড হওয়ার পরে গর্ভপাত হয়েছে বলে ধরা পড়ে।

বেশিরভাগ সময়ে ঋতুস্রাব খানিকটা পিছিয়ে গেলে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা না করেই অনেকে ভাবেন যে তিনি গর্ভবতী। কিন্তু তারপরে যখন ঋতুস্রাব পুনরায় শুরু হয় তখন সে মনে করে যে তার গর্ভপাত হয়ে গেছে।

কেন এমন হয়?

১. অনেক সময় জরায়ুর মাঝে সেপট্রাম নামক একটি পর্দা থাকে যা গর্ভবতী হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। সেপট্রাম অপারেশন করলেই গর্ভাবস্থায় আর কোনও সমস্যা হবে না। আবার জরায়ুর গঠনগত ত্রুটি অর্থাৎ জরায়ুতে পলিপ, টিউমার হলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে, যা অপারেশন করে ঠিক করা যায়।

২. যদি ডিম্বাণুর সমস্যা থাকে তবে তা মায়ের ক্রোমোজোমাল টেস্ট করে ও যদি শুক্রাণুর সমস্যা হয় তাহলে বাবার ক্রোমোজোমাল টেস্ট করে তা ধরা পড়ে। কিন্তু বাবা-মায়ের কারও কোনও সমস্যা না থাকলেও ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনের সময়ে সমস্যা হলে সেটি ক্রোমোজোমের সমস্যা রয়েছে বলেই ধরা হয়।

৩. মায়ের কোনও নির্দিষ্ট অসুখ থাকলেও রক্ত জমাট বেঁধে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মায়ের এসএলই (সিস্টেমিক লিউপাস এরিথেম্যাটোমাস) অসুখ থাকলে অর্থাৎ এতে শরীরের মধে্য এমন কিছু প্রোটিন তৈরি হয় যার জন্য রক্ত জমাট বেঁধে যায়। ভ্রূণ গঠন হওয়ার সময় জরায়ুতে অনবরত রক্ত সরবরাহের প্রয়োজন হয় তাই সে সময় রক্ত পরিমিত না থাকলে গর্ভপাত হতে পারে। তখন কিছু টেস্ট করে দেখা হয়, যেমন এপিএলএ, এসিএলএ। অর্থাৎ অ্যান্টি ফসফরাস অ্যান্টবডি অথবা অ্যান্টি কার্ডিওলজি অ্যান্টবডি রক্তে থাকলে সেক্ষেত্রে মিসক্যারেজের প্রবণতা বাড়ে।

৪. অনিয়ন্ত্রিত ব্লাডপ্রেসার, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা থাকলেও গর্ভপাত হতে পারে।

৫. শরীরে হরমোনের ভারসাম্য ঠিক না থাকলে ও এমন হয়।

৬. মেয়েদের ৩৫ বছরের মধ্যে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। তার মানে এই নয় যে তারপরে গর্ভবতী হওয়া যায় না। ৩৫ বছরের পর থেকে ডিম্বাণুর গুণগত মান কমে যায় এবং ৩৭ বছরের পর থেকে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

ফের প্ল্যানিংয়ের আগে সতর্ক

একাধিকবার গর্ভপাত হলে মা, বাবা-সহ পরিবারের সব সদস্যের মনের উপরই তার প্রভাব পড়ে। তাই পুনরায় গর্ভবতী হওয়ার আগে কেন বারবার গর্ভপাত হচ্ছে তা জানতে ডাক্তারের পরামর্শ মাফিক সবরকম টেস্ট করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত একাধিকবার গর্ভপাত হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেহেতু এই টেস্টগুলি খরচসাপেক্ষ তাই অন্তত দুবার গর্ভপাত না হলে এগুলি করার পরামর্শ দেওয়া হয় না।

বারবার গর্ভপাত হওয়ার পরও অনেকে তার প্রকৃত কারণ জানতে চান না। ফলে মায়ের শারীরিক সমস্যা নিয়ে প্রেগন্যান্সি নিলে তাতে পুনরায় মিসক্যারেজের সম্ভাবনা থাকে কিংবা ভ্রূণের অনেক ত্রুটি দেখা দিতে পারে। গর্ভপাত হওয়ার পর মায়ের অবশ্যই তার শারীরির অবস্থা নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। আলট্রাসাউন্ড এবং রক্ত পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রেগন্যান্ট হলে নিয়মিত খাদ্যতালিকায় ফলিক অ্যাসিড রাখতে হবে। মাকে প্রোজেস্টেরন ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। শরীরে হরমোনের ভারসাম্য কমে গেলে বাইরে থেকে তা ঠিক করার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। ব্লাড প্রেসার, থাইরয়েড ও ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণে রেখেই অন্তঃসত্ত্বা হওয়া উচিত। ওজন কম রেখে মাতৃত্বধারণ জরুরি। পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে হবে এবং নিয়মিত এক্সারসাইজ,যোগ ব্যায়াম করতে হবে। গর্ভবতী মহিলাদের পরিমিত ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গর্ভবতী হওয়ার আগে থেকেই শরীরকে গর্ভাবস্থার জন্য তৈরি করতে হবে। তার জন্য দৈনন্দিন কাজ বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। বরং কর্মঠ থাকাই শ্রেয়।

আরএম-১৩/২৯/০৫ (স্বাস্থ্য ডেস্ক, তথ্যসূত্র: সংবাদপ্রতিদিন)